Notice Board

৩১ জানুয়ারি ১৯৯৬

Sep 17, 2023 12:38 PM

৩১ জানুয়ারি ১৯৯৬ :

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে পুলিশি তাণ্ডবের এক নিকষ-কালো ভুলে যাওয়া অভিশপ্ত ইতিহাস। জগন্নাথ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যালঘু তথা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান সম্প্রদায়সহ আদিবাসী ছাত্রদের জন্য সংরক্ষিত হলবিশেষ। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম যে তিনটি হল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল জগন্নাথ হল তার অন্যতম । মানিকগঞ্জের বালিহাটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী'র পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে এই হলের নামকরণ করা হয়। এই হলের প্রথম প্রভোস্ট ছিলেন অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে বিখ্যাত অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, অধ্যাপক জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, রমেশচন্দ্র মজুমদার, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা এই হলের প্রভোস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব ও অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নৃশংস-অমানবিক অত্যাচার করে হত্যা করে এই হলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলই বারবার সাম্প্রদায়িক শক্তির হামলার শিকারে পরিণত। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এই হলেই হামলা করে বহু ছাত্র-শিক্ষককে নৃশংসভাবে হত্যা করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কর্মসূচি ছিল ১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ১৯৫২এর ভাষা শহীদদের স্মরণে নিবেদিত অনুষ্ঠানমালা এবং মাসব্যাপী একুশের বইমেলা উদ্বোধন করবেন । কিন্তু ১৯৯৬ এর জানুয়ারিতে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ -প্রতিরোধ ছিল তুঙ্গে। বিরোধী দলের ছাত্রসংগঠনসমূহ খালেদা জিয়ার বাংলা একাডেমীর অনুষ্ঠান উদ্বোধন প্রতিরোধ করার আহবান জানায়। প্রশাসন তখন সেই প্রতিবাদ প্রতিরোধকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে, বাংলা একাডেমিতে অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য হলগুলোতে পুলিশি অভিযান না চালিয়ে ; পুলিশি অভিযানের নামে স্বাধীন বাংলাদেশে অভূতপূর্ব বর্বর আক্রমণ চালালো জগন্নাথ হলে। ১৯৯৬ সালের ৩১ জানুয়ারি প্রায় ৭০০ পুলিশ আর বিডিয়ার জওয়ান নৃশংসভাবে হামলা চালালো জগন্নাথ হলে। ছাত্রদের উদ্দেশ্যে অশ্রাব্য এবং চরম সাম্প্রদায়িক কটূক্তি করে তাদের বেদম প্রহার করলো, লুঠতরাজ করলো হলের ছাত্রদের সামান্য সঞ্চয়, নষ্ট করলো তাদের বইপত্র। অপবিত্র করলো তাদের আরাধ্য দেব-দেবীর ছবি, প্রতিমা । হলের প্রত্যেকটা রুমে ঢুকে নৃশংস-অমানবিক অভিযান চালায় পুলিশ। শর্টগান দিয়ে গুলি করে, বুট দিয়ে ছাত্রদেরকে পিষ্ট করে, ডাইনিং রুম তছনছ করে অসভ্যতার ষোলকলা চূড়ান্তকরণ করে পুলিশ। এই হামলা চলে প্রায় ৩ ঘণ্টাব্যাপী । ৪০ টির বেশি রুম তছনছ করা হয়। হামলায় আহত হয় প্রায় তিনশত ছাত্র। পুলিশ গ্রেফতার করেছিল শতাধিক ছাত্রকে। তাদের মধ্যে কোর্টে চালান দিয়েছিল ৫৪ জনকে। কঙ্কর সিংহের "রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িকতা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় " বইতে দুইজনের মৃত্যুর কথাও পাওয়া যায়। সেদিন জগন্নাথ হল থেকে পুলিশ কোন অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল তারা ছিল মেধাবী ছাত্র। অনেকে ছিল পরীক্ষার্থী, তাদের কারও বিরুদ্ধে অতীতে সন্ত্রাসের কোনো অভিযোগ ছিল না।


আদালতেও তা প্রমাণ করা যায়নি। যার ফলে, 'ডিটেনশন'এর মামলায় জামিন না হলেও এ ক্ষেত্রে আদালত গ্রেফতারকৃত সব ছাত্রকে জামিন দিয়েছিল। হামলা শুরু হয় বিকাল ৩ টার দিকে। ৩৩৫ নাম্বার রুমে পুলিশ প্রথম আক্রমণ করে। অনুপ বসাক, শান্ত রেমাক, সেবাস্তিয়ান রেমা, কার্তিক চন্দ্র সেনা আর দীপঙ্কর সাংমা সেখানে গল্প করছিলেন। পুলিশ দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে আর টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। পুলিশ অনুপের মুখে গামছা পেচিয়ে ধরে যাতে সে চীৎকার করতে না পারে এবং অন্য পুলিশ না তাকে পেটায়। বুকসেলফ আর বিছানা পত্র তছনছ করা হয়। ছাত্রদের টাকা আর দামি জিনিষ লুট করা হয়। ৩৩১ নম্বর রুমের ছেলেরা খাটের তলায় লুকায়। সেখান থেকে পুলিশ তাদের বের করে পিটায়। বিপু কুমার নামে এক অতিথি ঢাকায় এসেছিলেন অসুস্থ আত্মীয়কে হাসপাতালে দেখতে। তার কাকা ছিলেন জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র। তিনি তার কাকার সাথে দেখা করতে জগন্নাথ হলে যান। তাকেও পুলিশ মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলে। ৩২৯ এর প্রকাশ বৈদ্য পরিচয়পত্র দেখিয়েও সাম্প্রদায়িক হায়েনাদের হাত থেকে বাঁচতে পারলেন না। ৩৩২ এর ৪ জন ছাত্রের ২ জন চারতলা থেকে লাফ দেয় জানালা দিয়ে। সেখানে সন্দ্বীপ এবং বিষ্ণু চক্রবর্তীর ঘড়ি লুট করে পুলিশ। ফিজিক্স এর ছাত্র ফোটন চন্দ্র সুত্রধরকে পুলিশ কাপড় দিয়ে মুখ চেপে ধরে তারপর কম্বল দিয়ে মুখ ঢেকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটায়। তাকে বলা হয় তাকে মেরে ফেলা হবে এবং তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। আরেক ছাত্র অজ্ঞান হয়ে গেলে পুলিশ তাকে মৃত ভেবে হলের বাইরে নিয়ে যায়। পুলিশ বিমল কৃষ্ণ বালা এবং অরুণ কে বালা কে চারতলা থেকে ফেলে দেয়। প্রথম জনের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যায় এবং দ্বিতীয় জনের পা ভেঙ্গে যায়। ৩৬০ নম্বর রুমের মিলন গোলদারকে মারতে মারতে পুলিশ তাদের লাঠি ভেঙ্গে ফেলে। ৩৮৮ আর ৩৯২ নম্বর রুমেও একই কাহিনী রিপিট হয়। ক্যান্টিনেও পুলিশ হামলা চালায়। ভোজনরত ছাত্রদের খাবার ফেলে দিয়ে তাদের পিটাতে থাকে। ক্যান্টিন বয় আর ম্যান্যাজারও অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে পারেনি। হামলার যারা শিকার, যারা প্রত্যক্ষদর্শী সকলেরই অভিমত হচ্ছে, একাত্তরে জগন্নাথ হলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যে হামলা চালিয়েছিল, গণহত্যার অংশটুকু বাদ দিলে ১৯৯৬-এর হামলা সেই বর্বরতা ও পৈশাচিকতার সঙ্গে তুলনীয়। সরকার ও মৌলবাদ সমর্থক ৬টি পত্রিকা বাদ দিলে সর্বাধিক প্রচারিত ইত্তেফাক ও জনকণ্ঠসহ ১৬টি জাতীয় পত্রিকার ১ ফেব্রুয়ারি সংখ্যার শিরোনাম ছিলো জগন্নাথ হলে পুলিশী নির্যাতনের সংবাদ। ঘটনার বিবরণ প্রায় সব কয়টি জাতীয় দৈনিকে ছিল একই রকম। সেই সময় এদেশের বিশেষ করে ঢাকার প্রগতিশীল জাতীয় দৈনিকগুলি যে ভূমিকা পালন করেছিল তা উল্লেখ করার মতো। অনেকগুলো দৈনিক সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় ও একাধিক কলাম লিখে তাদের ভূমিকাকে উজ্জ্বল করেছিল। দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক, কলামিস্ট সেইসব উপসম্পাদকীয় ও কলাম লিখেছিলেন। তবে সবচেয়ে প্রশংসনীয় দায়িত্ব পালন করেছেন শাহরিয়ার কবির। তিনি সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, হামলা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া, বিভিন্ন সংগঠনের বিবৃতি, হামলায় ক্ষয়-ক্ষতির বিবরণ, আহত ছাত্রদের তালিকা, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত আলোকচিত্র গ্রন্থিত করে প্রকাশ করেছিলেন একটি শ্বেতপত্র। খালেদা জিয়া সরকারের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের এই মুদ্রিত দলিল ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। ৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ভোরের কাগজে আবেদ খান "মন জয় করার বদলে যুদ্ধ জয় করলেন প্রধানমন্ত্রী" এই শিরোনামে লিখেছিলেন: "পুরনো কাগজ উল্টালে দেখা যাবে '৭৫ সালের আগস্টের পর থেকে এই একুশ বছরে জগন্নাথ হলের উপর পুলিশী এবং সরকারের পেটোয়া বাহিনীর হামলা হয়েছে কমপক্ষে ৫০ বার। কেবলমাত্র বর্তমান সরকারই নয়, জিয়াউর রহমানের আমলে এবং এরশাদের আমলেও এই ধরনের হামলা হয়েছে কয়েকবার। সব সরকারই যেন মনে করেছে জগন্নাথ হলের উপর একহাত নিয়েই বুঝি ভারতের উপর একহাত নেওয়া যায়। একি অদ্ভুত মানসিকতা! জগন্নাথ হলের মধ্যে কি প্রচুর পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র-গোলাবারুদ সবসময় থাকে বলে পুলিশ কিংবা প্রত্যেকটি সরকারের ধারণা? একটি ব্যাপার যে, যে স্থানটি বারংবার লক্ষ্যবস্তু হয়, সেই স্থানটিতে কেউ বেআইনি অস্ত্রশস্ত্র রাখবে না। তাহলে কেন করা হচ্ছে? কোন সুস্থ সরকার যদি হতো তাহলে তার প্রথম ও প্রধান দায়িত্বই হতো সংখ্যালঘুদের প্রতিটি অবস্থানের পরিপূর্ণ দায়িত্ব বিধান করা। তারা যে এই দেশেরই সম্মানিত নাগরিক-এ বোধটি তাদের মনের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা। তাহলে অন্ততপক্ষে আমাদের যে গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ সেটা যথার্থ মর্যাদায় অভিষিক্ত হতো। সেটা তো করা হয়নি উপরন্তু প্রতিটি টার্গেট করা হয়েছে তাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চালানো হবে, তালিকায় গোড়াতেই নাম রাখ জগন্নাথ হলের; বিক্ষোভ দমন করতে হবে, লাঠিসোটা নিয়ে ঢুকে যাও জগন্নাথ হলে; ছাত্রদের মধ্যে গোলাগুলি হচ্ছে, চালাও ভাংচুর জগন্নাথ হলে। একি কাণ্ড! মনে হচ্ছে ভারতের ওপরকার সব ঝাল ঝাড়া হচ্ছে জগন্নাথ হলের ওপর! যেন জগন্নাথ হল শায়েস্তা হলেই ফিট হয়ে যাবে ভারত।..." কেন জগন্নাথ হল বার বার আক্রান্ত হয়, কেন '৭৫ থেকে '৯৬ এই ২১ বছরে অর্ধশত বার হামলা চালানো হল জগন্নাথ হলে? আবেদ খানের লেখায় তার উত্তর আছে। ৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছিল মুনতাসীর মামুনের দীর্ঘ প্রবন্ধ "প্রধানমন্ত্রীর বাংলা একাডেমী অভিযান"- "... বিশ্ববিদ্যালয়ের এতগুলো হলের মধ্যে একমাত্র জগন্নাথ হলকেই টার্গেট করা হয়? ...এর কারণ কি এখানে হিন্দু ছাত্ররা থাকে? হলে ঢুকে ছাত্রদের 'মালাউন' বলা হয়েছে। তা হলে হিন্দুরা কি এদেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক?..." ৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদে সুলতানা নাহার লিখলেন "গণতান্ত্রিক সরকার (?) বনাম জগন্নাথ হল": "জগন্নাথ হলে যা ঘটেছে তা একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ভাল বলতে পারবেন। কিন্তু পরদিন সেখানে গিয়ে যা দেখেছি, তাতে আমি একাধারে শংকিত ও লজ্জিত হয়েছি। অনেকের ধারণা যে, এ হলের ছাত্ররা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছাত্র বলেই তাদেরকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের ওপর সুপরিকল্পিতভাবে নির্মম পুলিশী হামলা চালানো হয়েছে। এ হামলা পাকিস্তানী বাহিনীর হামলারই তুল্য, নৃশংসতা ও ব্যাপকতায়। একটি স্বাধীন দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, তা কোনো সুস্থ মানুষ বা সভ্য সমাজ মেনে নিতে পারে না।" শুধু বিএনপি কেন, এদেশের সব রাজনৈতিক দলের কাছেই তো গণতন্ত্র মানে নির্বাচনে ভোট পাওয়া না পাওয়া, নির্বাচিত সংসদ এবং সরকার গঠন এর বেশি কিছু নয়। গণতন্ত্র এদেশে কোনো দল কিংবা নেতাকে অসাম্প্রদায়িকতা এবং পরমতসহিষ্ণুতা শিক্ষা দেয় না। গণতন্ত্রের 'কনসেপ্ট' রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় যাই হোক, এদেশে গণতন্ত্র এবং সাম্প্রদায়িকতা পরস্পর বিরোধী নয়। সেজন্যেই শুধু সংখ্যালঘু ছাত্রাবাস জগন্নাথ হলে বারে বারে হামলা হয়, সেই হামলায় নেতৃত্ব দেয় সরকার, সেই সরকারকে সুলতানা নাহার সভ্য সরকার বলতে না পারেন তাতে তাঁর মানসিকতাকে আমরা অভিনন্দন জানাতে পারি, কিন্তু শেষ বিচারে সংখ্যালঘু ছাত্রদের কোনো উপকার হয় না। ১৪ ফেব্রুয়ারি কলম তুলে ধরলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী; লিখলেন "এ কোন বাংলাদেশ?": "...মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মুক্তিযোদ্ধাই ছিল পাক দখলদার বাহিনীর টার্গেট, নির্বিচারে বধযোগ্য শিকার। কিন্তু একটা বাড়তি ক্রোধ ও নিষ্ঠুরতা প্রদর্শিত হয়েছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী পুরুষের প্রতি। স্বাধীন বাংলাদেশেও একটি গোষ্ঠী, সরকারি ও বেসরকারি, হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের বিদ্বেষের চোখে দেখেন, অকারণে তাদের ওপর স্টিমরোলার চালান। গত ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ছাত্রদের আবাসিক হল জগন্নাথ হলে যে নারকীয় কাণ্ড ঘটালো বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা, তাই আমাকে এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, এ কোন্ বাংলাদেশে বাস করছি আমি?...।" ১৪ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক শফি আহমেদ দৈনিক সংবাদে লিখেছিলেন- "নির্বাচন, সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত": "...সংখ্যালঘু ছাত্রদের ওপর এটি একটি একতরফা পুলিশী দাঙ্গা ছাড়া আর কিছু নয়। পুলিশ খাবার থালা ফেলে দিয়ে বলেছে- হিন্দুরা রোজা রাখে না কেন, 'বল শালা জয়বাংলা বল' এমন চিৎকার করে তাদের হুংকার দিয়েছে, ...এই সরকারের আমালে বা এই সরকারের বাহিনীর কাছে সংখ্যালঘুদের মর্যাদা কি রকমের তার একটা প্রামাণ্য প্রদর্শনী দেখা গেছে জগন্নাথ হলে। ...। ৫ ফেব্রুয়ারি ভোরের কাগজে কলাম লিখেছিলেন প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব ও এসকাপের প্রাক্তন নির্বাহী সচিব শাহ এ.এম.এস কিবরিয়া "জগন্নাথ হলকেই আক্রমণের টার্গেট করা হল কেন?": "...বিএনপি সরকার যে ধর্মান্ধতার আশ্রয় নিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরীহ ছাত্রদের উপর জুলুম করবে তা অনেকেই ভাবতে পারেনি।" ৩১ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার পুলিশ বাহিনী 'মালাউনের বাচ্চা'দের ওপর যে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিল তার কিছু নমুনা উপরে তুলে ধরা হলো। তবে সম্পূর্ণ বিবরণ জানতে হলে শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত ৭২ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র দেখতেই হবে। বিএনপি, তার অঙ্গ সংগঠন, কয়েকটি চিহ্নিত মৌলবাদী দল এবং তাদের দলীয় মুখপত্র ছাড়া এদেশের সব রাজনৈতিক দল, ছাত্র-যুব-নারী সংগঠন, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পেশাজীবী জোট ও সংগঠন জগন্নাথ হলে হামলার নিন্দা, ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছিল। ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদ। দেশের প্রগতিশীল সাংবাদিক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা অনন্য দায়িত্ব পালন করেছিলেন তাঁদের লেখার মাধ্যমে। হল পরিদর্শনে গিয়ে সহানুভূতি প্রকাশ করেছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবীরা, পেশাজীবীরা, ছাত্র, যুবক, নারী, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা, কর্মীরা। সকলের সহানুভূনিতে জগন্নাথ হলের ছাত্রদের ভেঙ্গে যাওয়া মনোবল জেগে উঠেছিল। তারা এই ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ, নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তিনটি বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী ৩ ফেব্রুয়ারি' ৯৬, জগন্নাথ হলে পুলিশী বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে অর্ধদিবস হরতাল পালন করেছিল ঢাকায়। জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট এবং হাউস টিউটররা একযোগে পদত্যাগ করেছিলেন এই ঘটনার প্রতিবাদে। কিন্তু বিএনপি মনোনীত তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ এত দক্ষযজ্ঞের পরেও হল পরিদর্শনে যান নি। আহত ছাত্রদের দেখতে যাননি হাসপাতালে। ছাত্ররা তার বাসভবনে গেলে তাদের সাথে দেখা করেননি। পুলিশ সেখানেও ছাত্রদের লাঠিপেটা করে। 'মালাউন' ছাত্রদের জন্যে উপাচার্য এমাজউদ্দিন আহমদের ন্যূনতম সহানুভূতি বা কর্তব্যবোধ উদয় হয়নি। ৩১ জানুয়ারি ১৯৯৬, জগন্নাথ হলের হামলা সম্পর্কে সরকার কোন প্রেসনোট জারি করেনি। কেন এ ধরণের নৃশংস ঘটনা ঘটলো তার জন্যে কোনো তদন্ত কমিটিও গঠন করেনি। যে কোনো সময় এধরণের কোন ঘটনা ঘটলে সরকারের জন্যে সেটাই হয়ে দাঁড়ায় অস্বাভাবিক কাজ। বিএনপি সরকার সেটুকুও করে নি। তাদের বক্তব্য ছিল, ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা প্রধানমন্ত্রীর বাংলা একাডেমী আগমনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে পুলিশের উপর গুলি বর্ষণ করলে পুলিশ বাধ্য হয়ে জগন্নাথ হলে হামলা চালায়। পুলিশের বক্তব্য ছিল তারা 'সন্ত্রাসীদের' ধরার জন্য এবং অস্ত্র উদ্ধারের জন্যে জগন্নাথ হলে হামলা চালিয়েছে।


১৯৯৬ সাল ছিল স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীবর্ষ। আর জগন্নাথ হলে অহেতুক ছাত্রদের উপরে তৎকালীন সরকারের নির্মম অত্যাচার ছিল -অভাগা, চতুর্থশ্রেণীর এই মালাউন ছাত্রদের জন্যে সরকারের পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ স্বাধীনতার উপহার! (সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ ২০১০ সালে জগন্নাথ হলে প্রতিষ্ঠিত হবার পরে সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ ২০১১ সাল থেকেই এই নির্মম কালোদিনটিকে পালন শুরু করে। সে লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক এবং কঙ্কর সিংহের লেখা "রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িকতা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়" এ বইটিকে অবলম্বন কর সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ থেকে একটা লিফলেট তৈরি করা হয়। ভাবতে ভাল লাগছে আজ গুগলে ঐদিনের লেখা খুঁজতে যেয়ে পেলাম, "আমার ব্লগে" নিঃসঙ্গ গ্রহচারীর একটা লেখা ; যা কিনা ২০১১ সালের বিদ্যার্থীর লিফলেটকে একটু সামান্য উনিশ-বিশ পরিবর্তন করে এবং তার সাথে অল্পকিছু কথা যুক্ত করে লেখা। ভাল লাগলো পুরণো লেখাটি খুঁজে পেয়ে ।)