Login

Breadcrumbs

উৎসবমুখর পরিবেশে ‘পুনর্মিলনী ২০১৭’ আয়োজিত

উৎসবমুখর পরিবেশে ‘পুনর্মিলনী ২০১৭’ আয়োজিত

Reunion 2017

কর্মজীবনের শত ব্যস্ততার মাঝেও বছরের একটি দিন আমরা, জগন্নাথ হলের প্রাক্তন ছাত্ররা আনন্দঘন পরিবেশে অগ্রজ, সমবয়সী বন্ধু ও অনুজ এবং পরিবারের সদস্যদেরকে সাথে নিয়ে এক মিলনমেলার আসর সাজাই। তারই ধারাবাহিকতায় এ বছর বিগত ২০ জানুয়ারি, শুক্রবার আমরা মিলিত হয়েছিলাম আমাদের চিরচেনা ছায়াসুশীতল টিএসটি’র সবুজ কোমলালয়ে, যেখানে হেমিলনের বংশীবাদকের ন্যায় প্রতিনিয়ত এক মহাকর্ষণে টেনে নিয়ে যায়, সেখানে স্মৃতির সমুদ্রসফেন ঢেউয়ের দ্যোতনায় দিনমান আমরা অবগাহন করেছি নির্মল আনন্দে।

বলা বাহুল্য, নানা কারণে বৈচিত্র্যময় ও বৈশিষ্ট্যময়তায় ভরপুর ছিল ‘পুনর্মিলনী ২০১৭’। প্রথমত, জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠার প্রাক্কাল ১৯৯৮ সাল থেকে ইতিপূর্বে দুইবার বিজয়া পুনর্মিলনী, দুইবার বাংলা নববর্ষ পুনর্মিলনী এবং তেরবার বার্ষিক পুনর্মিলনী, অর্থাৎ সব মিলিয়ে সতেরবার সংগঠনের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের পর অষ্টাদশ এই পুনর্মিলনীতে রেকর্ড সংখ্যক পরিবারের সদস্যরা অংশগ্রহণ করেন। আট শ’র অধিক পরিবারের সদস্যসহ সব মিলিয়ে প্রায় আঠারো শ’ অংশগ্রহণকারী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। সকাল ৮টা থেকেই পরিবারবর্গসহ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা জড়ো হতে থাকেন তাদের প্রাণপ্রিয় জগন্নাথ হলের সন্নিকটে টিএসসি’র আঙ্গিনায়। বেলা ১১টা নাগাদ অডিটোরিয়াম কানায়-কানায় পূর্ণ হয়ে যাওয়ার ফলে সতীর্থরা ভীড় জমান টিএসটি’র উন্মুক্ত চত্বরে।

এবারের পুনর্মিলনীর উদ্বোধক- উপমহাদেশের খ্যাতিমান পার্লামেন্টারিয়ান, জগন্নাথ হল তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শারীরিক অসুস্থতার কারণে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি। উল্লেখ্য, অনুষ্ঠানের ঠিক ১৫ দিন পর তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে। তাই তাঁর জীবনকালের শেষ পুনর্মিলনীতে তদীয় অনুপস্থিতি আমাদের সকলের মর্মবেদনা হয়ে থাকবে চিরকাল। প্রসঙ্গত এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত’র জীবদ্দশায় সর্বশেষ করা তাঁর স্বাক্ষরসম্বলিত বাণী জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক আয়োজিত ‘পুনর্মিলনী ২০১৭’ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা ‘বিজয়া’য় মুদ্রিত হয়। এই ক্ষণজন্মা মহান জননেতার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এবং তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে সেই বাণী এখানে পুনর্মুদ্রিত হলো।speech

পুনর্মিলনীর প্রধান অতিথি- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং বিশেষ অতিথিবৃন্দ- যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. অসীম সরকার, ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ. কে. আজাদ এবং ভারতের বন্ধন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক চন্দ্র শেখর ঘোষ নির্দিষ্ট সময় অনুষ্ঠান মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন। তাছাড়া মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ড. দুর্গাদাস ভট্টাচার্য এবং ‘পুনর্মিলনী ২০১৭’র আয়োজক কমিটি’র আহ্বায়ক মিলন কান্তি দত্ত। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পান্না লাল দত্তের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান যৌথভাবে পরিচালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বীরেন্দ্র নাথ অধিকারী এবং যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও পুনর্মিলনী’র সদস্য সচিব মলয় কুমার সাহা। অতিথিবৃন্দ সম্মিলিতভাবে মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন।

12উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধে জগন্নাথ হলের অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং সেসব চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে বলে উল্লেখ করেন। তিনি জগন্নাথ হলের সাথে তার সংশ্লিষ্টতা, এই হলে তার সমসাময়িক বসবাসরত বন্ধু ও সহপাঠীদের সাথে সখ্যতা এবং বিশেষত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর অন্যান্যদের সাথে কীভাবে এই হলের আবাসিক শিক্ষকের বাসা থেকে তাকে আটক করা হয় সেসব স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

তিনি অতীতের সাথে বর্তমান রাজনীতির তুলনা করে সর্বত্র বিভাজনের দেয়াল গড়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেন। ওবায়দুল কাদের বলেন, এখন সামাজিকতার মধ্যেও পার্থক্যের রেখা বিরাজমান, কেউ মারা গেলে জানাজায়ও যাওয়া যাবে না, প্রেসক্লাব, চিকিৎসক, আইনজীবী সবার মধ্যে বিভাজন। এসবের ভবিষ্যৎ শুভ নয়, এই বিভেদ দূর করতে হবে বলে তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে, অন্ধকার দিয়ে অন্ধকার প্রতিহত করা যায় না, অন্ধকার দূর করতে চাই আলো এবং ভালবাসা দিয়ে জিঘাংসা ও সহিংসতা দূর করতে হবে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, রাজনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজকে মাদকের বিরুদ্ধে কথা বলতে শোনা যায় না। অথচ এটা একটা প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাই শুধু রাজনৈতিক বক্তৃতা নয়, মাদকের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন গড়ে তোলার উপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, আমাদের অভিন্ন বিপদ হলো সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদ, অভিন্ন শত্রু হচ্ছে দারিদ্র্যতা, আর অভিন্ন গৌরব হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে উগ্রবাদ ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। ওবায়দুল কাদের বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বলতে কেউ নেই, সবাই বাংলাদেশের নাগরিক, জাতি হিসেবে বাঙালি। তাই কোনো আঘাত আসলে সাহস নিয়ে প্রত্যাঘাত করতে এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে বলে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলের প্রতি ওবায়দুল কাদের দৃপ্ত আহ্বান জানান।

36অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার বলেন, বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ এমনই যে, এখানে জঙ্গিরা কখনোই সফল হবে না। তাই জঙ্গি রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা ব্যর্থ হবে। ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জগন্নাথ হলের ছাত্রদের মেধা, কৃতিত্ব এবং সফলতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক অগ্রযাত্রায় অ্যালামনাইদের সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানান। জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. অসীম সরকার বলেন, অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সকল কর্মকাণ্ডে জগন্নাথ হল প্রশাসন সহায়তা প্রদান করে আসছে এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ. কে. আজাদ বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ত্যাগ স্বীকারের প্রসঙ্গ আসলে জগন্নাথ হলের নাম সবার আগে স্মরণ করতে হবে। হলের গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসার জন্য প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। জগন্নাথ হলের প্রাক্তন আবাসিক ছাত্র ও ভারতের বন্ধন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্র শেখর ঘোষ বলেন, ধৈর্য্য, কঠোর পরিশ্রম ও ডেডিকেশন থাকলে জীবনে সফলতা আসবেই। অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ড. দুর্গাদাস ভট্টাচার্য এবং পুনর্মিলনী ২০১৭’র আহ্বায়ক ও অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম সহ-সভাপতি মিলন কান্তি দত্ত।

35তিলধারণহীন মিলনায়তনের ভিতরে যখন অতিথিবৃন্দ বক্তব্য রাখছিলেন, টিএসসি’র মাঠে তখন চলছিল গ্রুপভিত্তিক স্মৃতিচারণ, হৈ-হুল্লোড়, আড্ডা, হাসিঠাট্টা ও বন্ধুবাৎসল্য সুলভ যতসব তামাশা। সেই সাথে দল বেধে ছবি আর ডিজিটাল যুগের সেলফি তোলার হিড়িক পড়ে যায় সেখানে। এ যেনো অন্য এক জগৎ, অন্য এক প্রতিযোগিতা। মূলত জগন্নাথ হলের কোনো অনুষ্ঠানে এই প্রথমবারের মত ব্যাকস্ক্রীন এবং বাইরে বৃহদাকারের এল.ই.ডি. পর্দায় লাইভ ডিসপ্লের কারণে মিলনায়তনের ভিতর ও বাইরের অনুষ্ঠান একাকার হয়ে গিয়েছিল।

শীতকালীন এবং বাঙালিস্বাদের হরেক রকম রসনাবিলাসের পাশাপাশি মনোজগতের খোরাকে ললিত-ললিতাদের নৃত্যশৈলি, সুমধুর কণ্ঠশীলন, ডিজিটাল যন্ত্রঝঙ্কার, আর হাসিঠাট্টার সব মিলে মুখরিত ছিল টিসিএসটি’র আকাশ-বাতাস। জগন্নাথ হল অ্যালামনাই পরিবারের ছোট্টমনি এবং তাদের আদরের মামনিদের জন্য আলাদাভাবে আয়োজন ছিল ক্রিড়া ও বিনোদনমূলক বেশ কিছু অনুষ্ঠান। 38আর র‌্যাফেল ড্র’র বিজয়মুকুটে সুশোভিত পুরস্কার প্রাপ্তির উদগ্র বাসনায় শেষাবধি পেয়ে বসেছিল সকলকে বটে, কিন্তু পুরস্কার প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি নির্বিশেষে আনন্দে মদমত্ত ছিলেন সকলে, যার রেশ আগামীর মিলনবাসরাবধি থাকবে অমলিন নিশ্চিত।

পুনর্মিলনী ২০১৭ উপলেক্ষে ‘বিজয়া’ নামের একটি সমৃদ্ধ স্মরণিকা প্রকাশিত হয়। এতে জাতীয় পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য বিষয় এবং জগন্নাথ হলের প্রাক্তন ছাত্রদের স্মৃতিময় প্রবন্ধ, কবিতা ও ছড়া স্থান পায়।

 

পুনর্মিলনী ২০১৭-এর ছবি দেখুন