আগস্ট মাস বাঙালি’র শোকের মাস, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালে ইতিহাসের ভয়াল কালো এই দিনে পরিবারের সসদ্যবৃন্দ ও নিকট আত্মীয়-স্বজনসহ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের লেলিয়ে দেয়া নরপিশাচ-ঘাতকরা বুলেটের আঘাতে হত্যা করে। নির্মম সেই হত্যাকাণ্ডের ৪১তম বছরের জাতীয় শোক দিবসে আত্মাহুতীদানকারী শহীদদের স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ‘জাতির পিতার রক্তঋণ শোধ হবে না কোনদিন’ প্রতিপাদ্যসম্বলিত নিম্নোক্ত ৩টি কর্মসূচি পালন করে:
১। জাতীয় শোক দিবস ২০১৬ উপলক্ষে জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সহযোগিতায় ১৪ আগস্ট, রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে এক রক্তদান কর্মসূচি’র আয়োজন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জমান এই কর্মসূচি’র উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জমান বলেন- ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নরপিশাচ ঘাতকরা বুলেটে-বুলেটে জর্জরিত করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং ঘনিষ্ট আত্মীয়দেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তাই ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কময় এই দিন আমাদের জাতীয় শোক দিবস। জাতির পিতা রক্ত দিয়ে বাঙালি জাতিকে চিরকালের জন্য ঋণী করে গেছেন। তাঁর রক্তঋণ কোনদিন শোধ হবার নয়। সেই দিকটি বিবেচনায় এনে জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত আজকের রক্তদান কর্মসূচি মূলত জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর এক অনন্য নজির। মহতি এই উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য তিনি জগন্নাথ হল অ্যাসোসিয়েশনকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পান্না লাল দত্তের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ওয়াশিংটস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক প্রেস মিনিস্টার স্বপন কুমার সাহা, আওয়ামীয় লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজিত রায় নন্দী, জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. অসীম সরকার এবং অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বীরেন্দ্র নাথ অধিকারী।
সংক্ষিপ্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর বেলা ১:৩০মি. থেকে ৩:৩০মি. পর্যন্ত দুই ঘণ্টাব্যাপী শ্রদ্ধাবনতচিত্তে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ অনুষ্ঠানস্থলে রক্তদান করেন।
২। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিসবে অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পান্না লাল দত্তের নেতৃত্বে বাঙালি’র তীর্থস্থান ধানমন্ডি’র ৩২ নং সড়কে বঙ্গবন্ধু ভবনের সম্মুখন্থ জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের শহীদানদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
৩। জাতীয় শোক দিবস ২০১৬ উপলক্ষে জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যসোসিয়েশন ১৯ আগস্ট, শুক্রবার সকাল ১০টায় ‘বঙ্গবন্ধু ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার আর্টস অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এই আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জনাব মোহাম্মদ নাসিম, এমপি। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পান্না লাল দত্তের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান এবং আমন্ত্রিত আলোচক ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও জগন্নাথ হলের প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. অজয় রায় এবং বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ইংরেজি অনুবাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. ফকরুল আলম। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান এবং জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক অধ্যপাক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী ‘বঙ্গবন্ধু ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’ শিরোনামাঙ্কিত প্রবন্ধ রচনা এবং তা অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করেন (এখানে ক্লিক করে প্রবন্ধের কপি ডাউনলোড করুন)।
এছাড়াও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. অসীম সরকার, সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত, জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি জিতেন্দ্র লাল ভৌমিক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুকুল বোস, সংসদ সদস্য পংকজ নাথ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক রঞ্জন কর্মকার, রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুভাষ সিংহ রায় এবং আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটি’র সদস্য সুজিত রায় নন্দী। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বীরেন্দ্র নাথ অধিকারী।
প্রধান অতিথি মোহাম্মদ নাসিম তার বক্তব্যে বলেন- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান সবকিছুর উর্ধ্বে, তিনি বিশেষ কোনও দল, মত বা শ্রেণী-গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নন। কিন্তু দুঃখের বিষয় খালেদা জিয়াসহ বিএনপি’র সকল পর্যায়ের নেতাকর্মী ও তাদের জোটভুক্ত সংগঠনগুলো এতোটাই সংকীর্ণ যে তারা বঙ্গবন্ধুকে কোনভাবেই স্বীকার করে না। তারা একাত্তরের পরাজিত শক্তির উত্তরাধিকারী এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগী- যে কারণে তারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার চায়নি, বরঞ্চ বিচার প্রক্রিয়া প্রলম্বিত, এমকি বন্ধ করতে নানা প্রকার ষড়যন্ত্র করেছে। তারা কেউ আজ পর্যন্ত ১৫ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানায়নি। প্রসঙ্গত, চীনের মাও সে তুং, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ প্রমুখের স্ব-স্ব দেশের উদাহরণ উল্লেখ করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী বলেন- এসব দেশের সর্বপর্যায় থেকে তাদের জাতির পিতাকে যথাযোগ্য সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। বাংলাদেশে যারা বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকারের হীনমন্যতায় ভুগছেন তাদেরকে তিনি এর থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন- অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতি’র কারণে বাঙালি জাতি চিরকাল জাতির পিতাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। লাগসই শিরোনামাঙ্কিত এবং সময়োচিত আলোচনা সভা আয়োজন করার জন্য তিনি জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
আলোচনা সভায় অধ্যাপক ড. অজয় রায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের কথা উল্লেখ করে বলেন তাঁর এ সবকিছুই ছিল মূলত অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শভিত্তিক। এ কারণেই বৃটিশবিরোধী বিপ্লবীসহ প্রগতিশীল অনেক নেতাকর্মী এক সময়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে তাঁর ৭ মার্চ ’৭১ এবং ১০ জানুয়ারি ’৭২ এর ঐতিহাসিক ভাষণ দু’টি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ড. ফকরুল আলম ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ইংরেজি অনুবাদের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে বলেন- তিনি এতে দেখেছেন বঙ্গবন্ধু কীভাবে ক্রমান্বয়ে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতির প্রতি দৃঢ়চেতা হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’পাঠ করার জন্য ছাত্র-ছাত্রী, অর্থাৎ তরুণ প্রজন্মের প্রতি তিনি বিশেষ আহ্বান জানান।
সভার সভাপতি পান্না লাল দত্ত- প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি, আলোচকবৃন্দ, প্রবন্ধকার ও প্রবন্ধের উপস্থাপক এবং সাংবাদিকবৃন্দসহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।